বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০৯:২৯ অপরাহ্ন

ছোট সমস্যা বড় ক্ষোভ

ছোট সমস্যা বড় ক্ষোভ

ড. মাহবুব হাসান :

ছোট সমস্যা, ছোট ছোট বিরক্তি আর বেদনার বিন্দুগুলো যখন জমে জমে পাহাড় হয়ে ওঠে, তখন তার সমাধানের জন্য বড় গলায় চিৎকার করতে হয়। যদিও সেরকম কোনো ঘটনা এখনো ঘটেনি, তবে ঘটতে কি বেশি দেরি লাগবে? বিশেষ করে মহানগর ঢাকার বাসিন্দারা এর সাক্ষী। কারণ, তারাই সেসব বিন্দু বিন্দু বেদনার শিকার। সাক্ষী চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসিন্দরাও। তাদের বিক্ষুব্ধ আওয়াজ আমরা টিভিতে দেখেছি দুটি প্রাণ আবর্জনাভর্তি নালায় হারিয়ে যাওয়ার পর। হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও চট্টগ্রামের সেসব নালা-নর্দমা নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়নি। চট্টগ্রামের মেয়র দুষছেন সিডিসিকে, আর সিডিসি দোষ দিচ্ছে সিটি করপোরেশনকে। কিন্তু প্রাণ দুটি যে গেল তার দায় স্বীকার করেননি কেউ, দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা প্রার্থনার ধারে কাছেও যাননি।

রামপুরার বনশ্রী এলাকার অনেক বাসায়ই সকালে গ্যাস থাকে না। প্রায় দেড়-দুই মাস ধরে এমনটা হচ্ছে। একই রকম ঘটনা জানালেন মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকের এক গৃহিণীও। তিনি বললেন, দুপুরেও রান্না করতে পারি না কোনো কোনো দিন। গ্যাস কেন চলে যাচ্ছে সে নিয়ে গ্যাস কোম্পানির কোনো মাথাব্যথা নেই। গ্যাস অফিসে অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার মতো বড় সমস্যা নয় এটা। ঘণ্টাখানেক থাকে না গ্যাস, তারপর ঠিকই আসে। যেদিন সিএনজি স্টেশনগুলোতে রেশনিং করা শুরু হলো, সংবাদ শুনে একজন বললেন, তাহলে এ কারণেই সকাল-দুপুরে গ্যাস থাকছে না বাসাবাড়িতে? সত্যটা কে বলতে পারে? আপাতত আমি জানি না, কী কারণে সকালবেলায় গ্যাসের চাপ মোটেই থাকে না। গ্যাস অফিসের কর্তাদের সাথে যোগাযোগ থাকলে আসল কারণ জানা যেত। আবার ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়ও এরকম গ্যাস-প্রব্লেম থাকলে জানা যেত। সমস্যাটি প্রকট নয়, মহানগরের সব এলাকায়ও নয় হয়তো। তাই কোম্পানির দ্বারস্থ হয়নি কোনো ভুক্তভোগী। তবে এতে যে মনে ক্ষোভ জমে ওঠে, তা কিন্তু মিলিয়ে যায় না। মনের কোণে জমে থাকে, গ্যাস-কর্তৃপক্ষ জানে না। জানতে পারলে তারা কারণ ব্যাখ্যা করতে পারতেন। হ্যাঁ, পারতেন, কিন্তু আমাদের দেশে কি ব্যাখ্যা দেয়ার মন-মানসিকতা আদৌ আছে কোনো কর্তৃপক্ষের? আমরা তো দেখছি, সরকারি অফিসের লোকেরা যেমন মনে করে না যে তারা পাবলিকের সেবক, অফিসে আগত মানুষকে সেবা দেয়ার জন্যই তারা নিয়োগ পেয়েছেন। বরং উল্টো তারা মনে করেন, পাবলিকের শাসক প্রভু তারা। পাবলিক এলে তার দিকে এমনভাবে তাকান যে মনে হবে তিনি প্রভু, আর আগত লোকটি তার অধীনস্থ কেউ বা সেই শ্রেণীর। এই মানসিকতাই তাদের অনেকটা দুর্বিনীত করেছে। এ কারণেই গ্যাস সঙ্কট হলে তা পাবলিককে আগেভাগেই জানানোর কথা তাদের মনে আসে না।

সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তাদের জবাবদিহির কোনো বালাই নেই। তারা গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাংস্কৃতিক চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠেননি। প্রশাসনিক চেতনায় তাই জবাবদিহির বিষয়টি নেই। আবার এটাও সত্য যে, যে প্রশাসন চলছে বা অতীতেও চলে এসেছে তারাও জবাব দেয়ার মন-মানসিকতা লালন করেননি। ফলে আমাদের কথিত গণতন্ত্রে এবং গণতান্ত্রিক শাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে অপ্রতিরোধ্য কর্তৃত্বপরায়ণতা। তখন তারাই সব কিছুর মাথামুণ্ডু হয়ে ওঠেন। নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই জবাব দিতে নারাজ। কি করে নিজেকে তারা বা তিনি বোঝান যে তার কাজ খুব ভালো ও আরামদায়ক ও মনোহর? যা দেখতে সুন্দর তা দৃষ্টিহর হতে পারে! যা মন জয় করে তা মনোহর, এটাই তো জেনে এসেছি আমরা।

ঢাকা মহানগর অনেক সুন্দর হয়েছে। অনেক ফ্লাইওভার হয়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। কিন্তু গতি বাড়েনি বা যেজন্য শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে ওগুলো বানানো হয়েছে, সেই ‘যানজট’ কমেনি বরং বেড়েছে। কেন এমনটা হলো? সে কি প্ল্যানিংয়ের ভুল? নাকি ফ্লাইওভার ডিজাইনের ত্রুটি? নাকি ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্যে ত্রুটি?

ধরা যাক তেজকুনি পাড়ার ভেতর দিয়ে যে ফ্লাইওভারটি নির্মিত হয়েছে, সেটির কথা। মাঝখানে রেললাইনের ক্রস করে পশ্চিমপ্রান্ত নেমেছে বিজয় সরণির দোরগোড়ায়। আর পূর্বপ্রান্তটি নেমেছে তেজগাঁও শিল্প এলাকার প্রধান সড়ক শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ অ্যাভিনিউর পশ্চিম পাশে। এই ফ্লাইওভারে যাতায়াত যারা করেন তারা বোঝেন যে কেমন জ্যাম হয় যখন তারা বিজয় সরণি পার হতে চান। পার হতে গেলে তাকে আরো উত্তরে ইউ লুপ পর্যন্ত যেতে হয়। ওই অ্যাভিনিউ সব সময় এমন জ্যামে ভর্তি থাকে যে ইউ লুপ পর্যন্ত যেতে তাদের অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। অথচ এই ফ্লাইওভারটি যদি বিজয় সরণি ও তেজগাঁওয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ অ্যাভিনিউ ক্রস করে নেমে যেত, তাহলে কোনো রকম জ্যামের সৃষ্টি হতো না। যাতায়াতে গাড়ির প্রবাহ নিরবচ্ছিন্ন থাকত। ঠিক একই রকম সমস্যা আছে মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার ফ্লাইওভারেও। এটির দক্ষিণ থেকে উত্তরে আসার মাথাটি যদি কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি থেকে উঠত, তাহলে বেলি রোড থেকে আসা গাড়ির প্রবাহটি বাধাগ্রস্ত হতো না। সৃষ্টি হতো না জ্যামের। নাকাল হতেন না গাড়ির যাত্রীরা। আর উত্তর মাথার প্রবাহটি দক্ষিণে কাকরাইল মোড় পেরিয়ে নর্থ-সাউথ অ্যাভিনিউয়ে যদি নামতো তাহলে যাতায়াতপ্রবাহ অনেকটাই ইজি হতো। জ্যাম হতো না। তবে উত্তরের মাথাটি মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার পর রামপুরা বাজারের আগে নামত তাহলে জ্যাম হওয়ার তেমন কোনো আশঙ্কা থাকত না। গুলিস্তান ফ্লাইওভারে হকারদের দৌরাত্ম্যে যে বিশাল জ্যাম ও জটের সৃষ্টি হয় প্রতিদিন সকালে, তার কোনো সমাধানই করছে না দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষ। বনশ্রী থেকে বেরিয়ে ইউ লুপটি ভালো কাজ দিচ্ছে, কিন্তু হাতিরঝিল থেকে বেরিয়ে কোনো ইউ লুপ নেই। সেই ইউ লুপ তৈরি করা হয়েছে অনেক উত্তরে। ফলে হাতিরঝিল থেকে বেরিয়ে ওই ইউ লুপ পর্যন্ত যেতে দুর্ভোগ ও জ্যামের শিকার হতে হয়। কেন এই ইউ লুপটি এতটা দূরে নিয়ে গেলেন কর্তৃপক্ষ তা তারাই ভালো জানেন। কিন্তু ভুক্তভোগীরা ক্ষুব্ধ এ-নিয়ে।

হাতিরঝিলের নান্দনিক রাস্তা আর গতির কাছে ঢাকার অন্যান্য এলাকা অনেকটাই ম্লান। এটা আমরা মানি। কিন্তু এর রাত্রিকালীন সৌন্দর্য আর লাইটিং আমাদের যতটা মুগ্ধ করে, ঠিক ততটাই বেদনার্ত করে সেখানে বৈকালিক ভ্রমণে যাওয়া মানুষদের। কারণ, হাতিরঝিলের নোংরা ও পানির দুর্গন্ধ এসে লাগে ওই পথে যাতায়াতকারী ও ভ্রমণকারীদের নাকে। ওই পানিই কেবল নোংরা নয়, গোটা পরিবেশকে দূষিত করে রাখছে সবসময়। লেকের তলদেশ থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে গ্যাসের দমকা বুদবুদ উঠছে। নোংরা পানির দুর্গন্ধ চলাচলকারীদের নাক কুঁচকে দিলেও তারা এর বিরোধিতায় মিছিল করছে না। কারণ, আমাদের বাসিন্দারা পরিবেশ সচেতন নন। তারা পরিবেশের ব্যাপারে খুবই অসচেতন, যা একটি মহানগরের বাসিন্দাদের সাংস্কৃতিক ব্যর্থতা বলে মনে হয়।

হাতিরঝিল সুন্দর করা হয়েছে ঠিক, কিন্তু ঝিলের তলদেশের আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়নি হয়তো। হলে এমন পচা দুর্গন্ধ উঠত না লেক থেকে। আমি যতটা জেনেছি ও শুনেছি যে, লেকটিকে নান্দনিক ও পর্যটনপ্রিয় করে তোলার জন্যই এর পানি দূষণমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সাথে নিয়মিত লেকের পানি কেমিক্যাল ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে দূষণমুক্ত ও সুগন্ধিময় করে তোলারও ব্যবস্থা নেয়ার কথা ছিল। যারা এই লেক ও চারপাশের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে নিয়োজিত, তারা বিষয়টি কি ভুলে গেছেন? নাকি দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করছেন, আমরা জানি না। কিন্তু আমরা চাই লেকের পানি দূষণমুক্ত হলে আরো বেশি মানুষ এখানে বেড়াতে আসবে। আর চার পাশের যেসব রেস্তোরাঁ আছে, সেখানে খাদ্যপ্রিয় পর্যটকের আনাগোনাও বাড়বে। ঢাকা মহানগরে এমন কোনো জায়গা নেই, এমন কোনো পার্ক নেই যা মানুষের শ্বাস নেয়ার মতো উপযুক্ত। হাতিরঝিল সেই অভাব পূরণ করতে পারত।

ঢাকা মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকার রাস্তাঘাট এখন উন্নয়নের কাটাকুটিতে নাস্তানাবুদ। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের বিশাল থাম দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে কাজ হচ্ছে শম্বুকগতিতে। আমি গত দশ মাসে ওখানে চোখে পড়ার মতো গতিশীল কোনো কাজ হতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কাজ চলছে, তবে তার গতি সামান্যই। পাবলিক অফিসের মতোই জাতীয় প্রেস ক্লাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ অফিস। এই অফিসে আসেন নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষেরা, প্রেস-মিডিয়ার সহায়তা পাওয়ার আশায়। সাংবাদিকের কলমের ধার তলোয়ারের মতোই ধারালো, এটা আমরা বিশ্বাস করি। সাধারণ মানুষও তা বিশ্বাস করেন। সেই ধার এখন কতটা আছে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, তবে এখনো অনেক মানুষ তাদের কাছে আসে। সেই প্রেস ক্লাবের সামনে এমন জ্যাম হয়, যা কহতব্য নয়। ম্যাস ট্রান্সজিট কোম্পানি কি পারে না এই এলাকার কাজ দ্রুত শেষ করে দিতে?

আমি বলতে চাইছি মহানগরের বাসিন্দাদের ছোট ছোট ব্যথা-বেদনা জমে পাহাড় হতে সময় লাগবে না। সত্যিকার উন্নয়নের যে স্বপ্ন ও বাস্তবায়ন, তার আনন্দ অবশেষে বেদনা আর ক্ষোভে পরিণত হলে, সেই উন্নয়ন কি তারা মনে রাখবেন? নাকি উন্নয়নের ফলে যে কষ্ট আর বেদনার সৃষ্টি করেছে, তাই কেবল মনে এসে ঠুকরাবে?

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877